Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped
"মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, নিরাপদ সবজি উপহার"

শিরোনাম
কালিকাপুর মডেলে বছরব্যাপী বাড়ীর আঙ্গিনায় সবজি চাষ (চিত্রে মডেল)
বিস্তারিত

করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রভাবে বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা শৃঙ্খলহীন হয়ে উঠতে পারে। দেখা দিতে পারে খাদ্য সংকট, নেমে আসতে পারে দুর্ভিক্ষ। আর সে প্রভাব বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এসে পড়বে স্বাভাবিক। একদিকে করোনা মহামারিতে মানবিক বিপর্যয়, অন্যদিকে খাদ্য সংকট, এমন পরিস্থিতি মাথায় রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দূরদর্শী ঘোষণা প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন,  ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাননীয়  কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়েছেন নানা পদক্ষেপ।


এমনি এক যুগোপযোগী পদক্ষেপের নাম কালিকাপুর মডেলে বসতবাড়িতে বছরব্যাপী সবজি উৎপাদন। আর এ সবজি উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নের কাজ করে যাচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ৩২টি করে কালিকাপুর মডেলে স্থাপিত হচ্ছে সবজি উৎপাদন বেড। উপজেলা কৃষি অফিসের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এ প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। উপজেলা কৃষি অফিসার, কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার এবং উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের নিয়ে সুসংগঠিত টিম সুনিপুণভাবে এই কর্ম সম্পাদন করে যাচ্ছে। করোনা দ্বিতীয় ঢেউ পরিস্থিতিতেও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কালিকাপুর মডেলের সবজি বেড প্রস্তুতিতে কৃষকদের সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদান করছে।


একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের দৈনিক ২১৩ গ্রাম সবজি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমরা গড়ে মাত্র ৫৩ গ্রাম শাকসবজি গ্রহণ করি। এর কারণে এ দেশের কোটি কোটি মানুষ দৈহিক ও  মানসিক অসুখে ভুগছে। এরমধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছে শিশু এবং নারী। আমাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ, বিশেষ করে মহিলারা লৌহের অভাবে রক্তশূন্যতার শিকার। একমাত্র ভিটামিন-এ’ র অভাবে বছরে ৩০ হাজার শিশু অন্ধ হয়ে যায়। এসব সমস্যা সমাধানে শাকসবজি খাওয়ার বিকল্প নেই। কারণ শাকসবজি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছাড়াও সব ধরনের পুষ্টি সরবরাহ করে।


কালিকাপুর মডেলে সবজি চাষ
আমাদের দেশে প্রায় দুই কোটি বসতবাড়ি আছে। প্রায় সবারই বাড়ির চারপাশে কিছু পরিমাণ জায়গা সারা বছরই পতিত থাকে, যা সবজি চাষের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। কালিকাপুর মডেলে সবজি চাষের মাধ্যমে বসতবাড়ির পতিত জায়গাগুলোকে উৎপাদনমুখী করে একটি পরিবার সারা বছরের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি অতিরিক্ত আয়ও করতে পারে।


পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার কালিকাপুর নামক এলাকায় ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গবেষণা চালিয়ে গবেষকগণ এ মডেল উদ্ভাবন করেন। এ মডেলে সবজি চাষ প্রযুক্তি, বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
 

স্থান নির্বাচন : বসতবাড়ির যে জায়গায় দিনের বেশির ভাগ সময় রোদ লাগে, এমন জায়গা নিবিড় সবজি আবাদের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। আঙিনায় আলো আসার পথে বাধা দেওয়া বাড়ির আশপাশের বড় গাছের ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। ভবিষ্যতে বড় হয়ে ছায়া সৃষ্টি করতে পারে এমন গাছও জন্মাতে দেয়া যাবে না।


সবজি বাগানের আকার : বসতবাড়ির আঙিনায় ৫ মিটার ী ৬ মিটার (১৬ ফুট ী ১৯-২০ ফুট) মাপের বাগান তৈরি করতে হবে। বাগানের জন্য খোলা উঁচু স্থান বেছে নিতে হবে। প্রত্যেক বেডের জন্য নির্ধারিত সবজি বিন্যাস অনুসরণ করতে হবে।


কালিকাপুর মডেল অনুসারে বাড়ির পতিত জায়গায় ৫টি বেড তৈরি করতে হবে। নির্বাচিত জমিতে ৫ মিটার (১৬ ফুট) লম্বা ও ৮০ সেমি. (৩২ ইঞ্চি) চওড়া ৫টি বেড তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি ২ বেডের মাঝে ২৫ সেমি. (১০ ইঞ্চি) নালা রাখতে হবে। বাগানের যে দিকটা লম্বায় বড় সে দিকটি প্লটের দৈর্ঘ্য হিসেবে ধরে নিয়ে বাগানের নকশা করতে হবে। এ মডেলে জায়গার পরিমাণ, বেড ও সবজির সংখ্যা বাড়লেও অন্যান্য মাপ একই থাকবে।
বাগানের জমি, বেড ও নালা তৈরি : বাগানের জন্য চিহ্নিত জায়গার আবর্জনা পরিষ্কার করে নিতে হবে। বেড়া দেয়ার স্থানের ভেতরে চারপাশে জায়গা খালি রেখে নকশা অনুসারে চারদিকে ২৫-৫০ সেমি. (১০-২০ ইঞ্চি) নালা ও দুই বেডের মাঝখানে ২৫ সেমি. (১০ ইঞ্চি) নালা তৈরি করতে হবে। নালার মাটি বেডগুলোতে তুলে দিতে হবে।


সবজি বিন্যাস : কালিকাপুর মডেল অনুসারে বাড়ির পতিত জায়গা যথাযথভাবে সর্বোচ্চ ব্যবহার করে সারা বছর পারিবারিক শাকসবজির চাহিদা মেটানো যাবে এমন সবজি বিন্যাস করতে হবে। বছরব্যাপী ৮ থেকে ১৪ রকমের শাকসবজি অনায়াসে চাষ করা যায়। বেড বা সবজির সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।


প্রথম খণ্ডে পর্যায়ক্রমে লালশাক/ডাঁটাশাক/টমেটো। দ্বিতীয় খণ্ডে পর্যায়ক্রমে পুঁইশাক/গিমাকলমি/মুলা। তৃৃতীয় খণ্ডে পর্যায়ক্রমে গিমাকলমি/লালশাক/বেগুন। চতুর্থ খণ্ডে পর্যায়ক্রমে ধনিয়াপাতা/কাঁচামরিচ/মুলা। পঞ্চম খণ্ডে পর্যায়ক্রমে পালংশাক/পুঁইশাক/ বেগুন চাষ করা যেতে পারে। তবে, পারিবারিক চাহিদা, বাজারমূল্য, আবহাওয়া, স্থান, মাটির ধরন ও রুচি অনুযায়ী শাকসবজি নির্বাচন করা যেতে পারে।
বসতবাড়িতে নিরাপদ সবজি উৎপাদনে নিমোক্ত বিষয়গুলো অনুসরণ করলে কার্যকরী ফলাফল পাওয়া যায়।


পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ- পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ কৌশল অনুসরণ অর্থাৎ সবজির খেত পরিষ্কার রাখা, মরা ডাল, পাতা সংগ্রহ করে নিরাপদ স্থানে গর্ত করে ধ্বংস করা বা পুড়িয়ে ফেলা, আগাছা পরিষ্কার করা, জমিতে আলো বাতাস প্রবেশের জন্য অধিক ঘন করে চারা না লাগিয়ে সঠিক দূরত্বে চারা লাগানো, বিকল্প পোষক (যেখানে পোকামাকড় লুকিয়ে আশ্রয় নেয়) ধ্বংস করা, অধিক ঘন ডালপালা ছেটে দেয়া ইত্যাদি পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।


মাটি ও বীজ শোধন- সবজি লাগানোর আগে মাটি শোধন করে নেয়া, এক্ষেত্রে শতকপ্রতি ৩ কেজি চুন প্রয়োগ করা, ফসল সংগ্রহের পর শিকড়সহ গাছ তুলে ফেলা এবং আগুনে পুড়িয়ে মাটি শোধন করা (৩-৪ বছর পর পর ০১ বার)। বীজ শোধন নিম পাতার রস বা রসুন বাটার রস অথবা বাজারের প্রচলিত কার্বক্সিল ও থিরাম গ্রæপের ছত্রাকনাশক যেমন প্রোভাক্স (প্রতি কেজি বীজে ২.০০-২.৫০ গ্রাম হারে) দিয়ে বীজ শোধন করে বপন করা।
ভালো বীজ ব্যবহার- সুস্থ, সবল, রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। স্থানীয় কৃষি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে বালাইসহনশীল জাতের তথ্য জেনে সে অনুযায়ী জাত ব্যবহার করা।


আন্তঃপরিচর্যা- মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈবসার প্রয়োগ করা, এক্ষেত্রে গাছপ্রতি ০১ কেজি কেঁচোসার বা ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। মাটিতে বসবাসকারী পোকার পুত্তলী ধ্বংস করার জন্য মাঝে মাঝে প্লাবন সেচ দেয়া। মালচিং পদ্ধতির অনুসরণ করা, এক্ষেত্রে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি প্লাস্টিকের মালচিং ব্যবহার করা যেতে পারে।


জাব পোকাসহ ছোট ছোট পোকা দমনে বিঘা প্রতি ২৫-৩০টি হলুদ আঠালো/সাদা আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করা। সবজি ও ফলের মাছি পোকা দমনে চারা রোপণের ১০-১৫ দিনের মধ্যে ফসলভেদে বিঘাপ্রতি ১০-১৫ সেক্স ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করা। মাঝে মাঝে জমিতে পরিমিত পরিমাণে ছাই ছিটিয়ে পোকা দমন করা যায়। বিভিন্ন উপকারী পোকা যেমন- বোলতা জাতীয় ট্রাইকোগ্রামা, ব্রাকন, কোটেসিয়া, রেড লেস উইং, রেড বাগ, পেন্টাটোমিড বাগ, টেট্রাসটিকাস জমিতে ছেড়ে দিলে ক্ষতিকর পোকার ডিম, কীড়া পুত্তলী, মথ খেয়ে ফসলকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করে। বর্তমানে বাজারে এসব উপকারী পোকা কিনতে পাওয়া যায়। উপকারী পোকামাকড়ের আবাসস্থল সৃষ্টির জন্য আইল ফসল হিসেবে শিম, বরবটি, করলা ইত্যাদি লাগানো যেতে পারে।


জৈব বালাইনাশক ব্যবহার বাড়াতে হবে। জৈব বালাইনাশক যেমন-নিম পাতার রস, নিম বীজের গুঁড়োর মিশ্রণ, রসুন ও পেঁয়াজ বাটার রস, নিশিন্দার রস ইত্যাদি ব্যবহার করে প্রাকৃতিক উপায়ে পোকা দমন করা যায়। তাছাড়াও বর্তমানে বাজারে প্রায় ৩২টি জৈব বালাইনাশক পাওয়া যাচ্ছে, যেগুলো ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পোকামাকড় দমন করা যায়। এসব জৈব বালাইনাশকের কোনো সাইড ইফেক্ট নেই।


পোকার আক্রমণ অর্থনৈতিক ক্ষতি সীমা অতিক্রম করলে স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করে পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। তাদের পরামর্শ মোতাবেক সঠিক ওষুধ (বালাইনাশক), সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায়, সঠিক নিয়মে স্প্রে করতে হবে। বালাইনাশক স্প্রে করার পর অপেক্ষমাণ সময় অর্থাৎ কত দিন পর ফসল সংগ্রহ করবেন, সে নির্দেশনা মেনে চলা। এতে করে মানবস্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত থাকবে। পরিশেষে সবজি সংগ্রহের পর পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে পানি ঝেড়ে নিয়ে বাজারজাত করা উচিত। সর্বোপরি পোকা-রোগ দমনে সবজি বাগান নিয়মিত পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখা একান্ত জরুরি।

ছবি
প্রকাশের তারিখ
11/12/2022
আর্কাইভ তারিখ
31/12/2023